অপার সম্ভাবনা হারাচ্ছে অব্যবস্থাপনায়

Originally published in Samakal on 15 July 2023

ফসল ফলাতে গিয়ে বছর বছর সেচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন চাষি। বিদ্যুৎ সংকট, লোডশেডিং ও লো ভোল্টেজের কারণে তারা নিরবচ্ছিন্ন সেচ পান না। এমন পরিস্থিতিতে সূর্যের আলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের মাধ্যমে জমিতে সেচ দিতে প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিইএ)। কম দামে সেচ দেওয়া, বছরে অন্তত তিনটি ফসল উৎপাদন, নবায়নযোগ্য ও কার্বন নিঃসরণহীন শক্তি উৎপাদন করে জলবায়ুর পরিবর্তন রুখতে প্রকল্প দুটি নেওয়া হয়। কিছু এলাকায় সুফল মিললেও অব্যবস্থাপনার কারণে অধিকাংশ কৃষক পাচ্ছেন না সৌর সেচ প্রকল্পের সুবিধা। সরকারের এ সেবা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। এমন অভিযোগও রয়েছে, এ সেবা নিতে কৃষককে গুনতে হয় বাড়তি টাকা। কিছু এলাকায় সৌর সেচ পাম্প উদ্বোধনের পর বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে আবার অনেক স্থানে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। ফলে সরকারের প্রায় দেড়শ কোটি টাকার দুই প্রকল্প মাঠে মারা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে দেশে মাত্র ৩ হাজার সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত বাজেট ও নীতি সহায়তার অভাবে সম্ভাবনাময় পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না। এদিকে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘সৌরশক্তি ও পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি (পাইলট)’ প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। এ বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। প্রকল্পের আওতায় ৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০০ উপজেলায় ১০৫টি সোলার সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়।

৮২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বিএডিসির ‘সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন’ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের অক্টোবরে শুরু হয়ে এ বছরের জুনে শেষ হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয় ৩৪ জেলার ১৪১ উপজেলায়।

প্রতিটি সেচ পাম্প চালানোর জন্য স্থানীয়দের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কমিটি। প্রতি শতাংশ জমির জন্য ৫০ টাকা করে সেচ খরচ নেয় ওই কমিটি। এ কমিটি প্রতিবছর সরকারকে ১৫ হাজার টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করে।

অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে সেচ কাজ

দুই প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট এলাকায় অনুসন্ধানে নামে সমকাল। এর মধ্যে মানিকগঞ্জের ঘিওরের সদর ইউনিয়নের পুরোনো ধলেশ্বরী নদীর উত্তরপাড়ে চর ঘিওর এলাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৭ টাকা খরচ করে একটি সৌরচালিত সেচ পাম্প বসানো হয়। এখন পাম্পটি অচল পড়ে আছে। ফলে সদর ইউনিয়নের চর ঘিওর এলাকার শতাধিক চাষি সেচ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

কৃষক জহির মিয়া ও  দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রতি বিঘায় ১ হাজার টাকা হারে সেচ খরচ নেওয়ার কথা ছিল। তবে সৌরচালিত পাম্পটি চালু না হওয়ায় এখন বিদ্যুৎচালিত পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।

পাম্প পরিচালনার দায়িত্বে থাকা স্কিম ম্যানেজার ও সমিতির কোষাধ্যক্ষ রুহুল খান বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তিন দফা চেষ্টার পরও পাম্পটি চালু করা যায়নি।

তবে জেলা বিএডিসির (সেচ বিভাগ) সহকারী প্রকৌশলী তিতাস বলেন, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দুটি সোলার পাম্পে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে ঘিওরে কৃষকদের মধ্যে কোন্দল থাকায় পাম্পটি চালু করা যায়নি। এখন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গাজীপুরের শ্রীপুরে নান্দিয়া সাংগুন গ্রামে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিএডিসির সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ প্রকল্প। শীতলক্ষ্যা নদীতীরে বসানো সেচ পাম্পটির আওতায় জমি রয়েছে প্রায় ৫০ বিঘা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পাম্পটি নদীর কম গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। নদীর পানি একটু নিচে নামলে আর পানি ওঠে না।

বিএডিসি (ক্ষুদ্র সেচ) গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী ফারুক হোসেন জানান, সূর্যের আলো কম ও নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এ পাম্প দিয়ে ধানক্ষেতে সেচ দেওয়া যায় না। তবে সবজি ক্ষেতের জন্য এটি যথেষ্ট। এ সৌর পাম্প নদীনির্ভর। এ পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তোলার নিয়ম নেই।

ভোলার চরফ্যাসনের বিএডিসির প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে উপজেলার চারটি ইউনিয়ন। এর মধ্যে হাজারীগঞ্জ ও আবুবকরপুর ইউনিয়নে একটি করে ও আব্দুল্লাহপুরে দুটি পাম্প আছে। তবে এখানে সেচ সুবিধা পেতে কৃষককে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। উপকারভোগী কৃষক লোকমান হোসেন ও কামাল হোসেন জানান, প্রতি শতাংশ জমিতে সরকার ৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও সেচ কমিটিকে দিতে হচ্ছে ৭০ টাকা।

চরফ্যাসনের হাজারীগঞ্জ ২ নম্বর ওয়ার্ডের সেচ কমিটির সভাপতি কৃষক আয়ুব আলী বলেন, শুরুতে এককালীন সরকারি কোষাগারে ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়েছি এবং বছর বছর ৭ হাজার টাকা জমা দেওয়া লাগে। তাই বাড়তি টাকা না নিলে আমার লোকসান হবে।

বাড়তি টাকা নেওয়া হলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান বিএডিসির চরফ্যাসন উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হয়েছে বরিশালের গৌরনদীতে। সেখানকার কয়েকজন কৃষক বলেন, দিনে সূর্যের তাপে সৌর প্যানেলগুলো সচল থাকায় সেচকাজ পরিচালনা করা যায়। তবে রাতে বন্ধ থাকে। সৌর প্যানেলের সঙ্গে ব্যাটারি সংযোজন করা হলে রাতেও সেচকাজ করা যেত।

বরগুনার পাথরঘাটার মানিকখালী গ্রামে স্থাপনের দুই বছরেও চালু হয়নি বিএডিসি নির্মিত সোলার সেচ পাম্প। এমনকি পরিশোধ করা হচ্ছে না বার্ষিক ভাড়া ১৫ হাজার করে টাকাও। স্থানীয় কৃষকদের সমন্বয়ে সমিতির মাধ্যমে পাম্প পরিচালনার জন্য (স্কিম ম্যানেজার) সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্য হেমায়েত উদ্দীন অপুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।  তিনি বলেন, পাম্প-সংলগ্ন খাল থেকে পানি না পাওয়া, লবণ-পানি ওঠানামা বন্ধ করতে খালে স্লুইচগেট নির্মাণ না করায় পাম্পটি চালু করা যাচ্ছে না।

২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের ৯ নম্বর দক্ষিণ চর আবাবিল এলাকার বালুধুম গ্রামে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সৌর সেচ প্রকল্প শুরু করে। কৃষকের অভিযোগ, সোলারের বিদ্যুৎ দিয়ে যে পানি পাওয়া যায়, তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে তাদের বাড়তি টাকা খরচ করে ডিজেলচালিত পাম্পের মাধ্যমে জমিতে সেচ দিতে হয়। স্থানীয় কৃষক আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বালুধুম কৃষক সমিতি নামে একটি দল গঠন করা হয়। কাগজপত্রে উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা ২০ জন দেখানো হলেও বাস্তবে মাত্র তিনজন। তাদের মোট জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৮০ একর।

কৃষকদের অভিযোগ, গাছের ছায়ায় প্যানেলগুলো ঢাকা থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় সেচ পাম্পটি চলছে না।

প্রকল্প এলাকায় সুবিধাভোগী কৃষক বিউটি আক্তার, নুর মোহাম্মদ ও আবদুল ছামিদ বলেন, সোলারের সঙ্গে ব্যাটারি যুক্ত থাকলে সবসময় পাম্প চালানো সম্ভব হতো।

স্থানীয় কৃষক আব্দুল মান্নানের নামে প্রকল্প হস্তান্তর করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তিনি জানান, গত বছর তাঁকে প্রকল্পের আওতায় একটি সেচ পাম্প, সোলার প্যানেল ও পাম্প স্থাপনের জন্য ঘর করে দেওয়া হয়। তবে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় এক চাষির অভিযোগ, কৃষকের মতো না নিয়েই লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেখানে পাম্প স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে খালে পানি থাকে না। তা ছাড়া গাছের নিচে সৌর প্যানেল বসানোর কারণে সূর্যের আলো মিলছে না।

এ ব্যাপারে রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন বলেন, শুরুতে দ্রুত প্রকল্পের কাজ চালু করার তাগাদা ছিল। ফলে ভালোভাবে পরিকল্পনা করা যায়নি। এখন সেচ পাম্পটি স্থানান্তর করে উপযুক্ত স্থানে নিতে হলে বরাদ্দ লাগবে। সব সমস্যার কথা আমরা অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। আগামীতে এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য ব্যাটারি দেওয়ার কথা আমরা জানিয়েছি। কাগজপত্রে প্রকল্পের উপকারভোগী ২০ জন থাকলেও বাস্তবে তিনজন থাকার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, শুরু থেকে ২০ জনই সুবিধা পেয়েছেন। এখন হয়তো পানি কম উঠার কারণে অনেকে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

প্রকল্পের কথা জানেন না অনেক কৃষক

গত এপ্রিলে ৫ জেলার প্রকল্প এলাকার ৪৮০ কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছেন সমকালের স্থানীয় প্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে ৩৯৬ জনই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসির সেচ প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। যে ৮৪ জন প্রকল্প সম্পর্কে জানেন, তাদের মধ্যে সুবিধা পাচ্ছেন ১৬ জন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্পটির উপপ্রকল্প পরিচালক অশোক কুমার বিশ্বাস বলেন, পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি শতভাগ সফল। কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। তখন আমরা আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করব।

বিএডিসির প্রকল্পের পরিচালক মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, সেচ পাম্প মূলত কৃষকদের মাধ্যমে গঠিত সমিতি পরিচালনা করে। আমরা শুধু তদারক করি। তিনি বলেন, সৌর প্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। এসব কাজ স্থানীয়দের নিয়ে গঠিত কমিটির করার কথা।

ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা দিপাল বড়ুয়া বলেন, সেচ পাম্প সৌরবিদ্যুতে রূপান্তর করলে ৬ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ১৩ লাখ ডিজেলচালিত সেচ পাম্প সৌরবিদ্যুতে রূপান্তর করলে বছরে সাশ্রয় হবে ১০ লাখ টন ডিজেল। বিদ্যুৎচালিত প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার সেচ পাম্পও সৌরবিদ্যুতে চালানো সম্ভব। এতে কমবে কৃষির উৎপাদন খরচ এবং কার্বন নিঃসরণ। তিনি বলেন, একটি সোলার পাম্পে তিনটি শ্যালো পাম্পের কাজ হবে। সেই হিসাবে ২ লাখ ৬০ হাজার সৌরচালিত সেচ পাম্প বসানো গেলে আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে শতভাগ ডিজেলহীন সেচ চালু হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সৌরচালিত সেচ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কাঠামোগত সক্ষমতা লাগবে। সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

অভিযোগের বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিষয়টি আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। সোলার দিয়ে সেচ পুরোদমে চালু করতে আরও সময় লাগবে। পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ বা সৌরশক্তিচালিত সেচযন্ত্রে রূপান্তরের উদ্দেশ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীও সৌর সেচের ওপর জোর দিয়েছেন। সম্প্রতি একনেকে সৌরবিদ্যুতের আরেকটি প্রকল্প পাস হয়েছে।