Friday, October 4, 2024
spot_img

কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পেছনে বাজেটের একটা বড় পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in দৈনিক জনকন্ঠ on 29 August 2024.

কুইক রেন্টাল টিকিয়ে রাখা বিলাসিতা

এক সময় বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে জরুরিভাবে চালু করা হয়েছিল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের নামে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে চলেছে নয়ছয়। গত ১৪ বছরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে নয়ছয় হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা।

শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিগত সরকার বরাদ্দ রেখেছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই ব্যয় হতো কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নিজেদের স্বার্থে বছরের পর বছর বাড়ানো হয়েছে এগুলোর মেয়াদ।

অর্থাভাবে যখন দেশের অন্যান্য খাত ধুঁকছে তখন শুধু কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থে কেন্দ্রগুলোকে টিকিয়ে রাখাকে বিলাসিতা বলে মনে করছেন তারা। একইসঙ্গে যেহেতু বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইন বাতিল করেছে তাই এবার কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎ খাতের গলার কাঁটাগুলো বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
২০১০ সালে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীদের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অনুমোদন দেয়। আর এসব বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে- এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হলেও এসব কেন্দ্র গড়ে চলেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই অলস বসে ছিল।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই গিয়েছে এসব রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পরিচালন ব্যয়ে। এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

টাকার অবমূল্যায়নসহ নানাবিধ কারণে মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ। চলতি অর্থবছরেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পরিচালন ব্যয় হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা থেকে বেশিরভাগ অর্থই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ভর্তুকি বাবদ ব্যয় হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বেশিরভাগ অর্থই এসব বেসরকারি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ মেটাতে ব্যয় করা হয়েছে।

এই কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও তাদের উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট ফি কেন্দ্রগুলোকেই দিতে হয়, যার সম্পূর্ণটাই সরকারকে বহন করতে হয়। এই পরিমাণ অর্থ বিদ্যুতের অন্যান্য কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে ব্যবহার হলে তা দেশের জন্য উপকার হতো বলে মনে করছেন তারা।
২০০৯ সাল আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আটটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। সেই বছর আওয়ামী লীগ সরকার বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়।

এই আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম। সে সময় বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে ছিল সামিট গ্রুপ।

সরকার ঘনিষ্ঠ এই এই গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি ও সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানদের পারিবারিক ব্যবসা। মেয়াদ বাড়ানোর সময় ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ শর্তের কথা বলা হলেও ভিন্ন নামে টাকা নিয়ে যাচ্ছে মালিকরা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১০০ মেগাওয়াট একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে গড়ে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। ফলে কোনো বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করে বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেন্দ্র ভাড়া দিতে গিয়ে সরকারের লোকসান বাড়ে। এর বাইরেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস পরিচালনা সংক্রান্ত ব্যয় বাবদ আর অন্তত ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে বছর বছর।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ বছরে বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় ২৫ হাজার ৩১ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এজন্য পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় এক লাখ ৫৯ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল ৬৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ছিল পিডিবির ইতিহাসে রেকর্ড।

এ সময়ে শীর্ষ ১২টি কোম্পানিকে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। এত বিশাল ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার জন্য মোট ৪৯ হাজার ৩৯২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এর অধিকাংশই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, ২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ২৮ হাজার ০৯৮ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সচল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও। আর এর খেসারত হিসেবে বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই চুক্তি অনুযায়ী তথাকথিত ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বাবদ প্রতিবছর গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা করে গচ্চা দিতে হচ্ছে সরকারকে।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৮ তারিখ এক বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বিশেষ বিধান আইন স্থগিত করা হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে করা বিতর্কিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির (বিশেষ বিধান) আইনের অধীন চলমান সব কার্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উত্থাপিত বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত-২০২১) এর কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এই আইনের অধীনে চলমান সব ধরনের নেগোসিয়েশন, প্রকল্প বাছাই/প্রক্রিয়াকরণ এবং ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে এই আইনের অধীনে ইতোমধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

এতে করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখনই বন্ধ করা হবে কি না তা স্পষ্ট না হলেও এটি বন্ধ করা জরুরি উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’র (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৯-১০ সালের বিদ্যুৎ খাত এবং এখনকার বিদ্যুৎ খাত এক নয়। তখন জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিলো। চুক্তিগুলো ছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের।

কিন্তু এর পর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলো আমি বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, যখন দেখা গেল চাহিদার চেয়ে ৪০ থেকে ৪৮ ভাগ ক্যাপাসিটি বেশি তখনই তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল। দেশ এখন একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন এগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দেওয়া অর্থনীতির বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।

তিনি বলেন, যদিও আমরা বলে থাকি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের গড়ে সাড়ে সাত থেকে আট টাকা যায়। কিন্তু বাস্তবে কেন্দ্র ভিত্তিক হিসাবের সঙ্গে কুইক রেন্টাল যুক্ত করা হয় তা হলে কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে সরকারকে প্রতি কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ কিনতে হয় ৬০০ টাকায়। এটা বসিয়ে রেখে ভাড়া দেওয়ার কারণে হচ্ছে। আর এর চাপ কিন্তু দেশের মানুষকে নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, নো ইলেক্ট্রিক, নো পে বলা হলেও এসব কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পেছনে বাজেটের একটা বড় পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

বিগত সরকার কতিপয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে বছরের পর বছর কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে গেছে। যেহেতু অন্তর্র্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইন নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত দিয়েছে তাই আমরা বলব এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যেন আর মেয়াদ বাড়ানো না হয়। আর ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টা নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসে।

দেশজুড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের নামে কয়েক বছর যাবৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘কৃচ্ছ্র’ অভিযান চালায় গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করা আওয়ামী লীগ সরকার। কৃচ্ছ্রতার নামে বেশ কয়েকবার কমানো হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনও। ফলে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জীবন যাপন করতে হয়েছে মানুষজনকে। কিন্তু তবু বন্ধ করেনি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো।

বরং দিনের পর দিন বসিয়ে রেখে পরিশোধ করা হয়েছে এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ। ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ পদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলা হলেও ‘মেনটেন্যান্স কস্ট’ বা পরিচালন ব্যয়ের নামেই সরকারের কোষাগার থেকে বেরিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে বলে উল্লেখ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতটা একটা লুটপাটের খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া মানে হচ্ছে সেখানে সরকারের অপচয় বা চুরি হচ্ছে। যদি কোনো কেন্দ্র বছরে খুব কম ব্যবহৃত হয় কিংবা যেসব কেন্দ্র একেবারেই ব্যবহৃত হয়নি সেগুলো স্ট্যান্ডবাই হিসেবে থাকে তাহলে এগুলো চালু রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা জানতে পেরেছি গত অর্থবছরে সামিটের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।

দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপের ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এগুলো পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে পেয়েছে ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার দিক থেকে গ্রুপটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ৬টি কেন্দ্র বাবদ তারা পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাক্যাটের ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর ভাড়া ৮৮৩ কোটি টাকা। আর ষষ্ঠ সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্প, ভাড়া ৭৮৫ কোটি টাকা।

সপ্তম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি, এর ভাড়া ৬৮০ কোটি টাকা। নবম ডরিন গ্রুপের ৬ বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার ভাড়া ৬৫১ কোটি টাকা এবং দশম স্থানে দেশ এনার্জির চার বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পায় ৫১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী।

দেশ এনার্জি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শের ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে এসব হাজার কোটি টাকা। খাতটিতে চলেছে হরিলুট, যা জনগণের পকেট থেকেই গেছে। এখন সময় এসেছে সংস্কারের।

গত বছর সংসদে দেওয়া তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর তথ্য ॥ গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে তৎক্ষালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কেন্দ্রভাড়ার বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, বিদেশি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কোনো কোনোটির একাধিক কেন্দ্র রয়েছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য ধরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ তাদের ৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পেয়েছে অন্তত ১৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

সামিটের পরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। তারা সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পেয়েছে ৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। তারা ছয়টি কেন্দ্রের বিপরীতে ভাড়া পেয়েছে ৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।

চতুর্থ সর্বোচ্চ ভাড়া পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে করা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার আনুষ্ঠানিক নাম বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। তারা পেয়েছে ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি। উল্লেখ্য, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর পর প্রায় দেড় বছর সক্ষমতার বড় অংশকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়েছে। কারণ, উৎপাদিত বিদ্যুৎ আনার সঞ্চালন লাইন ছিল না।

রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে পেয়েছে ৭ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। এটি আইপিপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটি মূলত সরকারি সংস্থার মালিকানাধীন। বাংলা ট্র্যাক গ্রুপের মালিকানাধীন পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। ওরিয়ন গ্রুপের মালিকানাধীন পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে ৪ হাজার ৮০ কোটি টাকা।

সামিট ও ইউনাইটেডের যৌথ মালিকানাধীন খুলনা পাওয়ার কোম্পানি (কেপিসিএল) তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে পেয়েছে ৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। সংসদে দেওয়া তালিকায় ডরিন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সাতটি। তারা ভাড়া পেয়েছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।

এর বাইরে হরিপুর ৩ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা, হোসাফ গ্রুপ ২ হাজার ৮৬০ কোটি, মোহাম্মদী গ্রুপ ২ হাজার ৮৩৪ কোটি, এনডাব্লিউপিসি ২ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা, ম্যাক্স গ্রুপ ২ হাজার ৩৫১ কোটি, কনফিডেন্স গ্রুপ ২ হাজার ১৮৫ কোটি, সিকদার গ্রুপ ১ হাজার ৮৪৩ কোটি, বারাকা গ্রুপ ১ হাজার ৬৯৩ কোটি, প্যারামাউন্ট-বাংলা ট্র্যাক ১ হাজার ৬৩১ কোটি, সিনহা গ্রুপ ১ হাজার ৪৫৪ কোটি, রিজেন্ট গ্রুপ ১ হাজার ১৭২ কোটি এবং এনার্জি প্যাক ১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা ভাড়া পেয়েছে।

এর বাইরে রয়েছে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র। যেমন এনার্জিস পাওয়ার করপোরেশন পেয়েছে ৬৮৫ কোটি টাকা। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পরিবারের। রাজশাহীর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এনামুল হকের নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশন পেয়েছে ৬৬২ কোটি টাকা। কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলো খুব কম সময় চলে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে গেছে।

যেমন যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জির ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন বছরে নিয়ে গেছে ২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকত। তবে, সংসদে তখন ১১৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ করা হলেও এর মধ্যে ১১টি কেন্দ্রের কোনো কেন্দ্র ভাড়া উল্লে করা ছিল না। এসব কেন্দ্র উৎপাদনে থাক আর অলস থাক দুই ক্ষেত্রেই কেন্দ্রভাড়া থাকে।

কিন্তু সংসদে যে হিসাব দেওয়া হয়, তাতে বসিয়ে কেন্দ্রভাড়া কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়েছে এসব কেন্দ্রের মালিকরা। রয়েছে তৎকালীন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও হস্তক্ষেপ।