দেশে আবারো হাজার মেগাওয়াট ছাড়াল লোডশেডিং

    Originally published in Banik Barta on 25 July 2023

    সারা দেশে তাপপ্রবাহ বাড়ার সঙ্গে আবারো বেড়েছে লোডশেডিং। দুদিন ধরে এক হাজার থেকে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। রাজধানীতে লোডশেডিং তেমন একটা দেখা না গেলেও মফস্বলে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এজন্য পুরনো বিতরণ ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহে নানাবিধ জটিলতাকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা।

    গ্রীষ্মের শুরু থেকেই চাহিদামাফিক উৎপাদন বজায় রাখা নিয়ে বিপাকে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে তীব্র তাপপ্রবাহে বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। যদিও সে সময় জ্বালানি সংকটে উৎপাদন চালু রাখা নিয়েই বিপাকে ছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। কয়লা সংকটের কারণে পায়রার মতো বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। ওই সময় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে পিক আওয়ারে আড়াই থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছিল।

    বিপিডিবির গতকালের বিদ্যুৎ চাহিদার প্রক্ষেপণ ছিল, দিনে ১৪ হাজার ও রাতে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। যদিও পিজিসিবির তথ্য বলছে, রোববার রাত ১টা থেকে গতকাল বেলা ৩টা পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৬০০ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। এর মধ্যে রাত ১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং ছিল ১ হাজার মেগাওয়াট। এরপর সকাল ৬টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ৬০০-৮০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। আর বেলা ৩টায় লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের ওপরে।

    ২৩ জুলাই লোডশেডিং ছিল প্রতি ঘণ্টায় ৭০০ থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট। লোডশেডিংয়ের কারণে রাজধানীর বাইরে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলোয় বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো থাকলেও সক্ষমতা অনুযায়ী তা সরবরাহে বিপিডিবির খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যদিও ঠিক কী কারণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে, এ বিষয় সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেননি সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

    তবে তাদের দাবি, লোডশেডিং যতটুকু দেখা যাচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তা আরো কম। চাহিদার কাছাকাছি পরিমাণে সরবরাহ করা হচ্ছে বিদ্যুৎ। মফস্বলে লোডশেডিং হচ্ছে মূলত পুরনো বিতরণ ব্যবস্থা ও সরবরাহ-সংক্রান্ত নানা জটিলতার কারণে।

    এ বিষয়ে বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চাহিদা ও উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি হচ্ছে। তবে সেটির পরিমাণ সীমিত। এছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও ট্রান্সফরমারগত কিছু সমস্যার কারণে অনেক সময় বিদ্যুৎ দেয়া যায় না। ফলে লোডশেডিং হয়। পল্লী বিদ্যুৎ ছাড়া বিতরণ কোম্পানিগুলোর খুব বেশি লোডশেডিং নেই। কারণ পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ও বিতরণ লাইন বহুদিনের পুরনো হওয়ায় এ সমস্যা বেশি।’

    পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিপিডিবির সরবরাহকৃত বিদ্যুতের মধ্যে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এছাড়া জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ রয়েছে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট। কয়লা থেকে উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। বাকি ৩৫০ মেগাওয়াট আসছে সৌর, হাইড্রো ও বায়ুবিদ্যুৎ থেকে।

    দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় রামপাল ছাড়া অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় খুব বেশি কারিগরি ত্রুটি নেই বলে বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে। তাই রাজধানীতে মাসখানেকের বেশি সময় ধরে খুব বেশি লোডশেডিং দেখা যায়নি। তবে গত কয়েক দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হলেও রাজধানীর দুই বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) এলাকায় কোনো লোডশেডিং নেই। কোথাও কোথাও ২-১ ঘণ্টা লোডশেডিং দেখা দিলেও সেটি মূলত ট্রান্সফরমার বা বিতরণ লাইনে কারিগরি ত্রুটির কারণে।

    রাজধানীর বাইরে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বেশকিছু জেলায় তীব্র লোডশেডিং হচ্ছে। রাজধানীর বাইরে মফস্বল এলাকার বেশির ভাগই পল্লী বিদ্যুৎ। বিতরণ সংস্থাটির অন্তত চারটি এলাকায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে পরিমাণ লোড চাওয়া হয় ততটুকু বরাদ্দ পাওয়া যায় না। যে কারণে বরাদ্দকৃত বিদ্যুৎ সমন্বয় করতে গিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

    কয়েকদিন ধরে সিলেট অঞ্চলেও লোডশেডিংয়ের মাত্রা তীব্র হয়েছে। এ গরমে প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গ্রাহকরা জানিয়েছেন, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয়-সাতবার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করেছে। এর মধ্যে আবার গতকাল জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে সিলেট বিভাগের সব জেলায় প্রায় দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। পরে সরবরাহ শুরু হলেও বেড়ে যায় লোডশেডিং।

    এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাদির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্রিড ফেল করে আশুগঞ্জ থেকে ১৩২ কেভি সার্কিট-২ বন্ধ থাকায় সমগ্র সিলেট বিভাগে কিছু সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল।’ তবে গ্রিডে সরবরাহে বিপর্যয়ের কারণ জানাতে পারেননি এ প্রকৌশলী।

    এদিকে জ্বালানি সংকট ও কারিগরি ত্রুটির কারণে বর্তমানে প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে নেই বলে জানা গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বালানি সমস্যাই লোডশেডিংয়ের প্রধানতম কারণ। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকগুলোই বন্ধ রাখতে হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে। আবার বিল বকেয়ার কারণেও অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না।