দেশে মজুদ গ্যাসে চলবে আর মাত্র ৭ বছর

Originally posted in বণিকবার্তা on 05 March 2022

দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা ১ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। এর বিপরীতে গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় প্রাকৃতিক গ্যাসের মোট মজুদ আছে ১০ টিসিএফের (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) কিছু কম। তবে এর পুরোটাই উত্তোলনযোগ্য নয়। যেকোনো গ্যাসক্ষেত্রে মজুদকৃত গ্যাসের সর্বোচ্চ ৭০-৭৫ শতাংশ উত্তোলন করা যায়। এ অনুযায়ী দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ টিসিএফ। বার্ষিক চাহিদা বিবেচনায় এ মজুদ দিয়ে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা যাবে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত বছর পর্যন্ত।

শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনা অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক গ্যাসকে কেন্দ্র করে। প্রতি বছরই দেশের আবাসিক, শিল্পোৎপাদন ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে পণ্যটির ব্যবহারিক চাহিদা বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাড়ে ৭ বছরের আগেই মজুদ ফুরিয়ে আসবে। এ অবস্থায় এখনই বিকল্প উৎসের সংস্থান বাড়ানো না গেলে সামনের দিনগুলোয় জ্বালানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ২৭টি গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ ৯ হাজার ৯০১ বিলিয়ন ঘনফুট বা ৯ দশমিক ৯ টিসিএফের কিছু বেশি। এর মধ্যে উৎপাদনে থাকা ২০ গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ টিসিএফ গ্যাস। বাকি গ্যাসের মজুদ রয়েছে উৎপাদনে না থাকা সাত গ্যাসক্ষেত্রে, যার পরিমাণ এক টিসিএফের কিছু বেশি।

ভূতাত্ত্বিক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটি গ্যাসকূপ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা যায়। তবে বাংলাদেশের গ্যাসকূপগুলো অনেক পুরনো। অঞ্চলভেদে এসব কূপ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সে হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সাড়ে ৭ টিসিএফের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা প্রায় অসম্ভব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে যে পরিমাণ গ্যাসের মজুদ রয়েছে, তার পুরোটাই উত্তোলনযোগ্য নয়। কারণ এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্যর পাশাপাশি অনুত্তোলনযোগ্য অবশিষ্টাংশও থেকে যায়। গ্যাসের উত্তোলনযোগ্যতা নির্ভর করে গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ, গ্যাসের চাপ ও কূপের ওপর। এ অনুযায়ী একটি গ্যাসক্ষেত্রে মোট রিজার্ভের ৭০-৮০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। চাপ দিয়ে এর চেয়ে বেশি গ্যাস তুলতে গেলে সেখানে পানি চলে আসে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত উত্তোলন করা যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুদ হিসাবের ক্ষেত্রে বিদ্যমান উত্তোলন কার্যক্রম-সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যানগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। এর হেরফের হলে—যেমন বর্তমানে উত্তোলনে গ্যাসের যে চাপ পাওয়া যায় সেটি কমে এলে বা বেড়ে গেলে—উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ নিঃশেষ হওয়ার সময়েও হেরফের হতে পারে।

পাঁচ বছর আগেও দেশে গ্যাসের দৈনিক উত্তোলন ছিল ২৮০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশীয় কূপগুলো থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে সরবরাহ হচ্ছে আরো ৭৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি।

মূলত দেশী কোম্পানিগুলোর অধীনে পরিচালনাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকেই এখন উত্তোলন হচ্ছে কম। যদিও বিদেশী কোম্পানিগুলোর অধীনে চলমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উত্তোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে।

বঙ্গোপসাগরের গভীর-অগভীর অংশে ব্লকগুলোয় দুই দশক ধরে কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের অফশোর ও অনশোরে (গভীর ও অগভীর) অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক। এসব ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে না থাকায় বিদেশী কোম্পানিকে আকৃষ্ট করা যায়নি।

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, দেশীয় কোম্পানিগুলোর আওতায় থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোর বেশির ভাগই ষাট দশকের। উৎপাদনে থাকা এসব গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেলেও সঠিক সময়ে কম্প্রেসার বসানো হয়নি। যে কারণে উৎপাদন ঠিক রাখা যায়নি। অন্যদিকে বিদেশী কোম্পানিগুলোর (আইওসি) আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় কম্প্রেসার বসিয়ে উত্তোলন ঠিক রাখা হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট উত্তোলনের ৬৯ শতাংশই এসেছে আইওসিগুলো থেকে। এসব কোম্পানির অধীন গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে চারটি। গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রতিদিন ১৬১ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।

এ অবস্থায় দেশী কোম্পানির অধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নে সরকারের মনোযোগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এজন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন। সরকার না চাইলে এসব গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন করা যাবে না। কারণ এখানে বিপুল অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন। এতদিনে এ অর্থ বিনিয়োগ করলে এর সুফলও পাওয়া যেত।

দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য অনুযায়ী, জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতার কারণে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর রয়েছে। এ সময়ে দেশী-বিদেশী কোনো কোম্পানি নতুন করে জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখায়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সও দীর্ঘদিন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে ছিল। যদিও দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনার বৃহদংশ ঘুরপাক খেয়েছে পুরনো গ্যাসক্ষেত্রের উত্তোলনকে কেন্দ্র করে। নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো যায়নি। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমদানি করা এলএনজির পরিমাণও তেমন একটা বাড়ানো যায়নি। অতি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ায় দেশের জ্বালানি খাত এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। গ্যাস সংকটে শিল্প-কারখানার উৎপাদন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি বাসাবাড়ি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও গ্যাস সংকটে পড়েছে।

বিশ্ববাজারে এলএনজির উচ্চমূল্য এবং স্থানীয় সরবরাহ কমায় সরকার এখন স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের অনুসন্ধান বাড়ানোয় মনোযোগ দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি চুক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ইদানীং বাড়তি প্রয়াস চালাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সংকট মোকাবেলায় সরকারের লক্ষ্য হলো স্থানীয়ভাবে গ্যাসের বৃহৎ আকারে অনুসন্ধান চালানো। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এরই মধ্যে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। অনুসন্ধান-উত্তোলন কার্যক্রমে তাদের বরাদ্দ দেয়া আছে। বিশেষত অনশোরে অনুসন্ধান করার জন্য বাপেক্সকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অফশোরের জন্য দেশী-বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হচ্ছে। আমরা তাদের স্বাগত জানাচ্ছি। তবে বিদেশী কোম্পানিগুলো থেকে খুব একটা সাড়া পাচ্ছি না। তার প্রধান কারণ হলো আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে বাপেক্স এখন নতুন নতুন জায়গায় কাজ করছে। এক্ষেত্রে সময়েরও প্রয়োজন রয়েছে।