বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ একটি ‘লুটেরা মডেল’!

    Originally published in ShareBiz on 8 July 2023

    বিদ্যুৎ সংকট মেটাতে ২০০৯ সাল থেকে বেসরকারি খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। ছোট-বড় প্রায় ১০০ বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয় পরবর্তী কয়েক বছরে। তবে এসব কেন্দ্রের বড় অংশই বসে থাকছে। তারপরও গুনতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ, যা আবার দিতে হয় ডলারের রেটে। এ ক্যাপাসিটি চার্জ হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের একটি ‘লুটেরা মডেল’। ১৪ বছরে এ খাতে গচ্চা গেছে ৯০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার।

    বিদ্যুৎ খাতের চলমান ৬৭টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতির বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। ‘বিদ্যুৎ সেক্টরভুক্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয়। ডলারে পেমেন্টের কারণে পিডিবির লোকসানও থামানো যাচ্ছে না। এই দুর্বিত্তায়ন থামানো জরুরি।

    ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ আসবে নাÑএমন দাবিও মিথ্যা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ডলারে পেমেন্ট হয় বলে ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয়। বরং বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে স্থানভেদে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রির সুবিধা রাখা এবং সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে এক-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেবে এ দুটি শর্তই যথেষ্ট; সঙ্গে সহজ শর্তে ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তির বিষয়টিও থাকবে।

    ক্যাপাসিটি চার্জকে লুটেরা মডেল উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে আদর্শ হচ্ছে ওভারহোলিং চার্জ। যতটুকু সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উৎপাদনে থাকতে পারবে না (সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ), সে সময়ের জন্য একটা চার্জ দেয়া যাতে বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু মাসের পর মাস উৎপাদনে অক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া ‘বাজেট ড্রেনিং অপচুক্তি’।

    ডলারে পেমেন্টকে বিদ্যুৎ খাতের প্রধান সংকট হিসেবে প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশীয়, তাই তাদের ডলারে পেমেন্ট দেয়া অযৌক্তিক বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ডলার নয় বরং টাকায় পেমেন্ট দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ইউনিটপ্রতি উচ্চমূল্য, ক্যাপাসিটি চার্জ ও ওভারহোলিং চার্জ, স্বল্পমূল্যে জ্বালানি ও জমি, সহজ ব্যাংকঋণ, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা প্রভৃতির মাধ্যমে ‘বাজেট ড্রেনিং’ বন্ধ না করলে বিদ্যুৎ খাতের তহবিল সংকটের সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেছে আইএমইডি।

    প্রতিবেদনে পিডিবির লোকসানের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলেও দেখানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ১২ বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) লোকসান গুনেছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। তবে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। আগে বছরে যে লোকসান হতো এখন দুই মাসেই তার কাছাকাছি লোকসান হচ্ছে।

    দায়মুক্তি আইন বিদ্যুৎ খাতের লোকসান বয়ে আনছে বলেও উল্লেখ করেছে আইএমইডি। এক্ষেত্রে বলা হয়, ২০১০ সালে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ করেছে সরকার। আইনটির বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৬ সাল পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। আইনটির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’

    ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ উপশিরোনামে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’

    ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি।’ দায়মুক্তির আইনের বলে বিদ্যুৎ খাতের ইউনিটপ্রতি ক্রয়মূল্য ও খরচের মডেল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জসহ হিসাবে দেখা যায়, কিছু আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় উৎপাদন ব্যয় ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে।

    বিদ্যুৎ খাতের অদক্ষতা তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে, কয়েক ডজন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি দক্ষতা ৩০ শতাংশের কম। অর্থাৎ অনেক বেশি জ্বালানি পুড়ে এরা খুব কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বহু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর কম বলে একটানা সচল থাকতে পারে না। বড় সমস্যা কয়েক হাজার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র। সার্টিফিকেট অরিজিন নকল করে মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও চরম জ্বালানি অদক্ষ এসব প্ল্যান্ট এখন বিদ্যুৎ খাতের ‘গলার ফাঁস’। দেশে লোডশেডিং যত বাড়বে ক্যাপাটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র তত বেশি চলবে, ততই জ্বালানি অপচয়ের সমস্যা প্রকট হবে।

    বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের সমন্বয়হীনতাকেও বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইএমইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে খরুচে সঞ্চালন লাইন টানা হয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে আসতে বহু সময় লাগবে। এতে সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বল্প ব্যবহƒত হবে। রূপপুরও লোডসেন্টার থেকে বহু দূরে। ফলে সঞ্চালন লাইনের পেছনে অনেক বিনিয়োগ চলে যাবে। অর্থাৎ সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল বিশাল বিনিয়োগের রিটার্ন নগণ্য।

    এদিকে আইএমইডি বলছে, কারিগরি জ্ঞানহীন ও অভিজ্ঞতাহীন একদল দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপক ভুল ও অদূরদর্শী সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা এবং আইনি প্রক্রিয়ার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে অযোগ্য করে রেখেছে। বিশেষ করে চীন ও ভারতীয় সরবরাহকারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাত এখন বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি। এসবের সমাধানে দরকার মেধাবী, দূরদর্শী, ভবিষ্যৎমুখী স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।

    তিন শতাংশের বেশি সিস্টেম লস মানে চুরি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদ্যুতের সিস্টেম লস দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কারিগরি খাত বলে দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের লস ছাড়া অপরাপর সিস্টেম লস অগ্রহণযোগ্য। ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সিস্টেম লস থাকতে পারে।

    প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর কারণ, জ্বালানি ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের সরবরাহ করতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়।

    আইএমইডির প্রতিবেদনে পিডিবি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), নেসকো, স্রেডা, ইজিসিবি, পাওয়ার সেল, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), আরপিসিএলসহ বিভিন্ন সংস্থা ২০১৩ সাল থেকে নেয়া ৬৭টি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতিকে ‘হতাশাজনক’ বলে উল্লেখ করে আইএমইডি বলেছে, সাত বছর পেরিয়ে গেলেও কিছু কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন মাত্র ১০ শতাংশ। প্রথম বছরে কোনো প্রকল্পেরই অগ্রগতি হয়নি।