Originally published in Bonik Barta on 16 July 2023
দেশের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎই কিনতে হচ্ছে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস (আইপিপি) ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে নেয়া হয় ৪০ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। বেশি মূল্যের এ বিদ্যুৎ নিতে গিয়ে বিপিডিবিকে গুনতে হয়েছে এ খাতে মোট খরচের প্রায় ৭০ শতাংশ। যেখানে পাঁচ-ছয় বছর আগেও এ ব্যয় ছিল মোট খরচের অর্ধেক।
আইপিপি থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করতে গিয়ে প্রতি বছরই বিপিডিবির দেনা বাড়ছে। সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৮ হাজার ৯৯৫ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা (আমদানিসহ)। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ পেতে বিপিডিবির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ৯৪ হাজার ২৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) ৭০ শতাংশ ব্যয়কে হিসাবে নিলেও আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেনার পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৬৫ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকায়। তবে এ খরচের প্রাক্কলন ছিল সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শুরুর দিকের। আর গত কয়েক বছরের প্রবণতা অনুযায়ী বিপিডিবির মোট বিদ্যুৎ ক্রয়ে আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অংশ ক্রমেই বাড়ছে। গত অর্থবছরের শুরুর দিকের তুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও জ্বালানি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি হিসাব করলে মোট খরচ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিপিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিডিবির নিজস্ব ও যৌথ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বেশি বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মূলত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের আর্থিক মুনাফা করতেই বিপিডিবি পর্যাপ্ত সুযোগ দিয়েছে বলে তাদের দাবি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসরকারির ওপর বিদ্যুৎ খাত নির্ভরশীল হবে, এ খাতের পলিসি অনুযায়ী এটাই স্বাভাবিক। এখন বাড়বে আমদানিনির্ভরতা। সরকার তার পলিসি বাস্তবায়নে বেপরোয়া। বিদ্যুৎ খাত আমদানি ও বাণিজ্যিকীকরণ হবে, তাতে জনস্বার্থ রক্ষিত হবে কিনা সেটি তাদের দেখার বিষয় নয়। যদি এ খাতের নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো পদক্ষেপ থাকত, তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো লাগত না। বিপিডিবির ব্যয়ও বাড়ত না।’
বিপিডিবির গত পাঁচ অর্থবছরের ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটিকে বিদ্যুৎ ক্রয়সহ মোট খরচের ৭০ শতাংশই ব্যয় করতে হয়েছে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে। অথচ চাহিদার বিপরীতে বিপিডিবি ও যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে। এর ফলে গত কয়েক অর্থবছরে বিপিডিবির আর্থিক দায়-দেনা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ভর্তুকির পরিমাণও।
সংস্থাটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনাসহ মোট ব্যয় ছিল ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে খরচ হয় ৫২ হাজার ৩ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে আইপিপি থেকে ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা ও রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ ব্যয় হয় ২ হাজার ৭৮৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
বিপিডিবির ব্যয় ও আইপিপি বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরেই যে আর্থিক ব্যয় বেশি হয়েছে বিষয়টি এমন নয়, বিগত পাঁচ অর্থবছর ধরেই তা আনুপাতিক হারে বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিপিডিবির মোট ব্যয় ছিল ৫১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইপিপি ও রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে খরচ যথাক্রমে ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি ও ৩ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে সংস্থাটির এ খাতে মোট ব্যয় ছিল ৪১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইপিপি খাতে ব্যয় ছিল ১৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পেছনে খরচ হয় ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট খরচ হয়েছিল ৪১ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, যেখানে আইপিপির ব্যয় ১৫ হাজার ৭৪৮ কোটি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় ৫ হাজার ১৩ কোটি টাকা। বিপিডিবিকে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ব্যয় করতে হয়েছিল ২৯ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইপিপির পেছনে ব্যয় ছিল ১০ হাজার ৪১১ কোটি এবং রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৬ হাজার ২৮২ কোটি টাকা।
এ পাঁচ অর্থবছরের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় পর্যায়ক্রমে কমে এলেও আইপিপি থেকে বেড়েছে। আবার আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ কেনায় গত পাঁচ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদও বিপিডিবিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এ চার্জ মূলত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা খরচ। ৮০ শতাংশ কেন্দ্র ব্যবহার হবে এমন শর্তেই চার্জটি নির্ধারিত হয়। কিন্তু বিগত পাঁচ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অর্ধেক কিংবা তারও কম সক্ষমতা ব্যবহার হয়েছে। এর বিপরীতে অব্যবহৃত সক্ষমতার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে বিপিডিবিকে। গত পাঁচ অর্থবছরে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পেছনে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ ব্যয় ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৫২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে আইপিপিগুলো বছরের পর বছর বিদ্যুৎ সরবরাহে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। মূলত প্লান্ট ফ্যাক্টরে বিপিডিবির যেসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা সহজলভ্য ও ব্যয় কম হয়েছে, সেখান থেকেই তারা বিদ্যুৎ নিয়েছে। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি সংকট দীর্ঘদিনের। তাই বিপিডিবি জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়েছে। স্থানীয় গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম। বিপরীতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেশি। ফলে হিসাব অনুযায়ী খরচ বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিআইপিপিএ চেষ্টা করছে বিপিডিবির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে। এতদিন সেটি করেও এসেছে। তবে বিপিডিবির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে এটি এখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা (ইনস্টল ক্যাপাসিটি) ২৪ হাজার ২৬৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় নয় হাজার মেগাওয়াট (আইপিপি ও রেন্টাল)। বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের মোট ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে ৪০ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিপিডিবিকে গুনতে হয়েছে ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। তবে সংস্থাটি বলছে, বিপিডিবি, স্বায়ত্তশাসিত ও যৌথ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বেড়েছে। খরচ বিবেচনায় এখন সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকেই বেশি বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে।
বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে বেসরকারি খাত থেকে বেশি নেয়া হলেও সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকেই বেশি বিদ্যুৎ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা অনেক বেশি। পাশাপাশি গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকেও বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে এখন।’
দেশে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে বেসরকারি খাত থেকে বেশি বিদ্যুৎ নেয়ার পেছনে মূলত জ্বালানি সংকট অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি বিপিডিবির অদক্ষ কেন্দ্র ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় এক ধরনের বাধ্য হয়ে বেসরকারি খাত থেকে বেশি বিদ্যুৎ নিয়েছে সংস্থাটি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশির ভাগ গ্যাসভিত্তিক। এছাড়া পুরনো অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলো সক্ষমতায় যুক্ত রয়েছে। এসব অদক্ষ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেশি। বিপিডিবি বেশি বিদ্যুৎ পেতে তাই বেসরকারি খাতের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি নির্ভরশীল হয়েছে। আর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যয়বহুল। ফলে সেখানে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। অর্থ ব্যয় হয়েছে বেশি।’
সরকার বর্তমানে দক্ষ ও কম খরচে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে প্রাধান্য দিচ্ছে, যেখানে বিপিডিবির ব্যয় কমিয়ে আনার মতো বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত বলে জানান খাতসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের লক্ষ্য হলো নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ। এজন্য দক্ষ ও খরচ কম হয় এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বরাবরই প্রাধান্য পায়।’ আইপিপি থেকে গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ কেনা যেমন বেড়েছে, তেমনি বিপিডিবির আর্থিক ব্যয়ও বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট হারে সেটি বেড়েছে। তবে এখন সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ছে। ফলে ব্যবহারও আনুপাতিক হারে সেভাবেই হবে।’