Originally posted in বণিকবার্তা on 16 March 2022
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষকদের যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তখন রংপুরের একাধিক উপজেলায় সৌরচালিত পাতকুয়া সবজিচাষীদের স্বস্তি এনে দিয়েছে। মাত্র ২০০-২৫০ টাকায় এক বিঘা রবিশস্যের খেতে সেচ দিতে পারছেন চাষীরা। এতে একদিকে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমছে, অন্যদিকে ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা হচ্ছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) জেলায় ১৭টি পাতকুয়া নির্মাণ করেছে। ফলে প্রায় ৬৮০ বিঘা জমি সাশ্রয়ী সেচের আওতায় এসেছে। এতে উপকৃত হয়েছেন দেড় সহস্রাধিক সবজিচাষী।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন বিশেষ করে রানীপুকুর ইউনিয়ন সবজি চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানকার সবজি ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান। কিন্তু ডিজেলের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকায় কৃষকদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিএমডিএ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে মিঠাপুকুর উপজেলায় পাতকুয়া নির্মাণ করা হয়েছে চারটি। এর মধ্যে রানীপুকুর ইউনিয়নের মাদারপুর গ্রামের কৃষক মো. বেলাল মণ্ডলের তিন শতক জমিতে নির্মিত হয়েছে একটি। তিনি বলেন, পাতকুয়ার আশপাশে ২৫ বিঘা জমি পাইপের মাধ্যমে সেচের আওতায় এসেছে। সাশ্রয়ী সেচের কারণে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাড়তি ফিতা পাইপ লাগিয়ে আরো ১৫ বিঘা জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তার এলাকায় সবজি চাষ বেশি হয়। আবাদকৃত সবজির মধ্যে কাঁকরোল, শিম, করলা, পটল, লাউ, শসা, পেঁয়াজ ও রসুন অন্যতম। সুবিধাভোগী কৃষকদের একজন মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ষাট শতক জমিতে আগাম আলু আবাদ করেছিলেন। দুবার সেচ দিয়েছিলেন। এজন্য খরচ হয়েছে মাত্র ২০০ টাকা। অথচ পাতকুয়া নির্মাণের আগে একবার সেচ দিতেই গুনতে হতো ৮০০ টাকা।
পাতকুয়া পরিচালনাকারী অপারেটর কৃষক মো. বেলাল মণ্ডল বলেন, তার এক একর জমিতে শিম আবাদে তিনবার সেচ দিতে হয়েছে। এর আগের বছর শিমের জমিতে একবার সেচ দিতে খরচ হয়েছিল ৬০০ টাকা। তিনি আরো বলেন, জমিতে সেচ কতবার দিতে হবে এটি নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। যদি বৃষ্টি বেশি হয় তাহলে সেচ কম লাগে। ফাল্গুন চৈত্র মাসে সেচ বেশি লাগে। বর্তমানে তার এলাকায় কৃষক ব্যস্ত আবাদকৃত কাঁকরোলের জমি পরিচর্যায়। অনেক কৃষক আবার কাঁকরোল সঙ্গে আদা আবাদ করেছেন।
এদিকে পাতকুয়ার খবর আশপাশের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে সাশ্রয়ী সেচ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এদের মধ্যে জুমা মৌজার কৃষক রেজওয়ান এবং আফজালপুর মৌজার ইলিয়াস বলেন, প্রকারভেদে সবজির জমিতে সেচ লাগে ২-৬ বার। নিজস্ব স্যালো মেশিন হলে এক বিঘা জমিতে একবার পানি দিতে চার লিটার তেলের প্রয়োজন হয়। যদি পানি কিনতে হয় তাহলে সেচ বাবদ খরচ আরো বাড়ে। বর্তমানে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৮১ টাকার ঊর্ধ্বে। ফলে সেচ খরচ বাড়ছে। অথচ পাতকুয়ায় সেচ খরচ তেমন নেই বললেই চলে।
পীরগঞ্জ উপজেলার ধনশালা গ্রামে নির্মিত পাতকুয়া পরিচালনার দায়িত্বে আছেন কৃষক আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, পাতকুয়া নির্মাণ করার পর সবজিচাষীদের বেশ উপকার হয়েছে। কারণ এখন অনেক কম খরচে তারা সেচ নিতে পারেন। তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে সেচ বাবদ তাকে দেয়া হয় মাত্র ২০০-২৫০ টাকা। এ টাকা দিয়ে ক্যানেল সংস্কার, পাইপের লিক সারানোসহ পাতকুয়া রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
বিএমডিএ মিঠাপুকুর জোনের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রায়হান হাবীব বলেন, মিঠাপুকুরের চারটি পাতকুয়া তিনি দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, পাতকুয়াটি পরিচালনায় একজন কৃষককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মূলত পাতকুয়াটি ওই কৃষকের জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে। পাতকুয়ায় ১২০ ফুট বোরিং করা হয়েছে। কুয়ার মধ্যে ৬২ ফুট নিচে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। কুয়ায় মোট ৮৪টি আরসিসি রিং পাত আছে। একটি পাতকুয়া চলে পাঁচ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন আটটি সৌর প্যানেল দিয়ে। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত পাম্পটির পানি সংরক্ষণে একটি টাওয়ারের ওপর তিন হাজার লিটারের ট্যাংকি স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, একটি পাতকুয়া থেকে ২৫ বিঘা পর্যন্ত শুধু আবাদকৃত সবজি চাষের জমিতে সেচের জন্য ডিজাইন করা থাকলেও ব্যাপক চাহিদা থাকায় বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে।
রংপুর বিএমডিএ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের অধীন সবচেয়ে বেশি রংপুর জেলায় ১৭টি পাতকুয়া নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নীলফামারীতে আটটি, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট জেলায় চারটি করে আরো ১৬টি পাতকুয়া নির্মিত হয়েছে।
বিএমডিএ রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং ইআইআরপির প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে পানি উত্তোলন হওয়ায় এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকায় পাতকুয়া শতভাগ পরিবেশবান্ধব। পাশাপাশি সুবিধাভোগী কৃষকদের উৎপাদন খরচ অনেক কমে গেছে। এটি একটি সমন্বিত পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় বলে পানির অপচয় কম হয়। যে কৃষকের জমিতে পাতকুয়া নির্মাণ করা হয় মূলত তিনি পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, তাই পারিশ্রমিক হিসেবে সুবিধাভোগীদের কাছে থেকে সমঝোতার মাধ্যমে কিছু টাকা পেয়ে থাকেন।