Originally posted in বণিক বার্তা on 01 November 2022
কভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রলম্বিত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার আভাস। বৈশ্বিক সংকটের প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশের প্রবল আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, খাদ্য সংকট আসন্ন, যা দুর্ভিক্ষে রূপ ধারণ অবাঞ্ছিত কিছু নয়। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যের চেয়ে সরকার এবং আমজনতার জন্য জ্বালানি-দুর্ভিক্ষ বা ‘ফুয়েল ফ্যামিন’ মোকাবেলা এখন চিন্তার বিষয়।
বাংলাদেশে জ্বালানি ব্যবস্থা আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় বেশি। ফলস্বরূপ বিগত এক দশক ধরে দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ চলছিল, কিন্তু বিশ্ব বাজারে তেল ও গ্যাসের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে ন্যাশনাল গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ কমে এসেছে। আমদানিনির্ভরতা এবং নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের প্রতি সরকারের অনীহা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতির অন্যতম কারণ, যার ফল দৈনন্দিন জীবনে দুর্বিষহ লোডশেডিং। শুধু গ্যাস নয়, পেট্রোলিয়ামের ক্ষেত্রেও ৯০ ভাগ নির্ভরতা আমদানিভিত্তিক। বর্তমান সরকারের যাবতীয় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা এলএনজি নিয়ে। যার পুরোটাই আমদানি করতে হয় কাতার এবং ওমান থেকে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ভাবা উচিত বিকল্প। বিশ্বব্যাপী গ্রিন এনার্জি মুভমেন্টের ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রচলন ও বর্তমান শক্তি ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন একটি সার্বজনীন বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে নিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ২০৫০ সালে মধ্যে বিভিন্ন নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হোম সিস্টেম, সোলার মিনিগ্রিড প্রজেক্ট, সোলার ইরিগ্রেশন প্রোগ্রাম নানা রকম উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে। যদিও সেই বাস্তবায়নের পরিধি উল্লেখ্যযোগ্য নয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে বায়োগ্যাস, সোলার ইত্যাদিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হলেও বায়ুশক্তির সম্ভাবনা এখন সার্বিকভাবে গবেষণাধীন। তথ্যমতে মোট ১২টি রায়ুশক্তিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার প্রয়োজনীয় গবেষণা, ফিল্ড স্টাডি ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং বিনিয়োগের ব্যবস্থা নিচ্ছে। তার মধ্যে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় উইন্ডব্যাটারি হাইব্রিড পাওয়ার প্লান্ট পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। যদিও তা এখনো জাতীয় গ্রিডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ২০০৬ সালে স্থাপিত ফেনীর সোনাগাজীর মুহুরীদাম উইন্ড টারবাইন পাওয়ার প্লান্ট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করলেও বর্তমানে তা যান্ত্রিক ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে স্থগিত রয়েছে। সম্প্রতি ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সরকার মোংলা গ্রিন পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে ৫৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি উইন্ডপ্লান্ট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মতামত অনুযায়ী, বাংলাদেশের বায়ুশক্তিভিত্তিক পাওয়ার প্লান্টের সম্ভাবনা ইতিবাচক।
বায়ুকল স্থাপনে যথাযথ গবেষণার বিকল্প নেই। আইসল্যান্ডভিত্তিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লোকসমাগম বেশি এবং পর্যটনকেন্দ্রিক জায়গাগুলো বায়ুকল স্থাপনে সবচেয়ে অনুপযোগী বরং তুলনামূলক দুর্গম, পাখিদের আবাসন ও খাদ্য সংগ্রহস্থল থেকে দূরে অবস্থিত জায়গাগুলো আদর্শ স্থান। একই সঙ্গে এটিও দেখতে হবে যে বায়ুকলগুলো যেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যথাসম্ভব উঁচুতে এবং ঝড়-বৃষ্টির বেগতিক চাপ থেকে নিরাপদ থাকে। আমেরিকান জার্নাল অব ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চের গবেষণা অনুযায়ী, ভৌগোলিকভাবে ভারত মহাসাগর বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণ দিক থেকে যে বাতাসের প্রবাহ ঘটায় তা বায়ুশক্তির জন্য একটি অনুকূল নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের মোট ৫৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে। ভারত মহাসাগর থেকে আসা শক্তিশালী দক্ষিণ/দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু জলপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার পর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রবেশ করে। মার্চ-অক্টোবর পর্যন্ত এ বাতাস সারা দেশে প্রবাহিত হয়। দেশের ভূ-আকৃতির উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করলে এ বাতাসের গতি বৃদ্ধি পায়। এ বাতাস বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যার গড় গতি ৩ মিটার/সেকেন্ড থেকে ৬ মিটার/সেকেন্ড। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাতাসের গতি তুলনামূলক কম থাকে। জুন-জুলাই (৩০) মাসে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৩০ মিটার উচ্চতায় বার্ষিক গড় বাতাসের গতি ৫ মিটার/সেকেন্ডের বেশি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ ৪ দশমিক ৫ মিটার/সেকেন্ডের ওপর যেখানে দেশের অন্যান্য অংশে বাতাসের গতিবেগ প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিটার/সেকেন্ড চমত্কার শক্তি নিষ্কাশনের জন্য। সাইটে কমপক্ষে ৭ মিটার/সেকেন্ড বাতাসের বেগ থাকতে হবে। বায়ু টারবাইন সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য হারের উচ্চতা সাধারণত ২০-৪০ মিটার। উচ্চতা সংশোধনের পর দেখা গিয়েছে, পতেঙ্গা, কক্সবাজার, টেকনাফ চরফ্যাশন, কুয়াকাটা, কুতুবদিয়াসহ কিছু অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ মিটারে বায়ুশক্তি ব্যবহারের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের হার বেড়েছে, যার অন্যতম কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রশমনে বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়শীল দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। একটি বায়ুকল থেকে বর্জ্য উৎপাদনের হার অন্যান্য পাওয়ার প্লান্টের চেয়ে কম, যা পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখে। ক্লিন এনার্জি হওয়ার কারণে বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে না। ফলস্বরূপ বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রশমনের ক্ষেত্রে বায়ুশক্তি একটি উল্লেখযোগ্য বিকল্প, এছাড়া বায়ু টারবাইনগুলো বাতাসের উপস্থিতির কারণে ১০০ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন শক্তির উৎস হিসেবে কার্য পরিচালনা করতে পারে। অন্যান্য পাওয়ার প্লান্টের তুলনায় নির্মাণ প্রযুক্তি এবং খরচ তুলনামূলক কম। একটি কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে যেকোনো প্রকল্পের সঙ্গে কৃষি এবং পানি সম্পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকা জরুরি যেহেতু বায়ুকল স্থাপনে অপেক্ষাকৃত কম জমি প্রয়োজন হয়, সেহেতু কৃষি ক্ষেত্রে তা কোনো বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। এছাড়া ইকোট্যুরিজম এবং টেকসই উন্নয়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এ শক্তির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে এটা সংরক্ষণ করা যায় না। যে কারণে তাত্ক্ষণিক শক্তি ব্যবহার করতে হয়। যার কারণে বাংলাদেশ সরকারের এটাকেই কখনোই প্রধান বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এছাড়াও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাতাসের ঘনত্ব সব সময় আশানুরূপ থাকে না। যার কারণে এর ইউনিটপ্রতি কার্যকারিতা অন্যান্য শক্তির তুলনায় বেশ কম। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রধান নজর হওয়া উচিত নবায়নযোগ্য শক্তিকে বর্তমান জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতিস্থাপক হিসেবে ব্যবহার করা। তবে সেটা স্বল্পমেয়াদি নয়, হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি, আর দীর্ঘমেয়াদে ফুয়েল ফ্যামিন মোকাবেলা করতে দরকার বিকল্পের বিকল্প। আর এ বিকল্পের বিকল্প হিসাব এখন সময় এসেছে বায়ুশক্তিবিষয়ক বিনিয়োগ, গবেষণা ও প্রকল্পকে একটি সুষ্ঠু কাঠামো এবং নীতিমালার মধ্যে সংযুক্ত করা।
বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে বায়ুশক্তিভিত্তিক পাওয়ার প্লান্টের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। বায়ুশক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত নেদারল্যান্ডস থেকে বিদেশী বিনিয়োগ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকে একটি কাঠামোগত বায়ুশক্তি নীতি ও কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এক্ষেত্রে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় জরুরি। বিশ্বমন্দা মোকাবেলায় আমদানিনির্ভর জ্বালানি থেকে সরে এসে শক্তির একাধিক বিকল্প নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।