Originally posted in দৈনিক ইত্তেফাক on 25 January 2022
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। নিত্যদিনের এ সেবাপণ্যটির পাইকারি দাম প্রায় ৬৯ শতাংশ বাড়াতে চায় এ খাতের শীর্ষ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়লে খুচরা দামও বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি কার্যকর এবং চলতি জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়ার মধ্যেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো।
বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) এবং পিডিবি সূত্র জানায়, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এর পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়মূল্য বাড়ানোর জন্য গত কয়েকমাস ধরে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা চলছে। সেই ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে এই খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠায় পিডিবি। তাদের চিঠি পাওয়ার পরদিনই দামবৃদ্ধির প্রস্তাব বিধি মোতাবেক হয়নি জানিয়ে তা আইন-বিধি অনুসরণ করে আবার পাঠানোর জন্য চিঠি দেয় বিইআরসি। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এখন সে নির্দেশনা অনুসারে প্রস্তাব তৈরি করছেন। চলতি সপ্তাহেই তা বিইআরসিতে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন পিডিবির এক সদস্য।
দেশে একমাত্র পিডিবিই পাইকারিমূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা চুক্তিমূল্যে কিনে নেয় পিডিবি। প্রতিষ্ঠানটি সেই বিদ্যুৎ পাইকারি মূল্যে বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে। এর মাঝে সঞ্চালন বাবদ হুইলিং চার্জ (মাশুল) নেয় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)। বিদ্যুতের সাম্প্রতিক মূল্যহার সমন্বয়ের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে দেখা যায় পাইকারি দাম বৃদ্ধির পরপরই খুচরা দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে একইসঙ্গে দামবৃদ্ধির ঘোষণা দেয় বিইআরসি।
বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির জন্য পিডিবির একটি আবেদন পেয়েছি। কিন্তু তা প্রবিধান অনুযায়ী যথাযথ হয়নি। ফলে পরদিনই ফেরত পাঠিয়েছি। বিধি মোতাবেক ফের প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। তবে সে প্রস্তাব এখনও পাইনি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, দেশজ গ্যাসের সংকট প্রকট হওয়া, বিশ্ববাজারে এলএনজি এবং জ¦ালানি তেলের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকায় গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে রেকর্ড লোকসান গোনে পিডিবি। এ বছরও তেলের দামবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ আরও কমার পূর্বাভাস রয়েছে। বিদ্যমান মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিক্রি ও সরবরাহ করা হলে লোকসানের পরিমাণ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাড়বে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে যেমন দাম পরিশোধ করতেই হবে তেমনি গ্রাহকদেরকেও সরবরাহ করতে হবে। তাই লোকসান কমাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। তাই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
দামবৃদ্ধির প্রস্তাবে যা থাকছে
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পিডিবির আগের প্রস্তাবে যা ছিল সংশোধিত প্রস্তাবেও আর্থিক বিষয়গুলো প্রায় একই থাকবে। শুধু বিধি অনুসরণ করে যুক্তি ও গাণিতিক হিসাব প্রদর্শন করা হবে।
গত সপ্তাহে দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ফার্নেস অয়েল আমদানি বাড়াতে হয়েছে। অথচ গত জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে এ বাবদ খরচ ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। এতে গত অর্থবছর শুধু জ্বালানি বাবদ ব্যয় ৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা বেড়েছে। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩ টাকা ১৬ পয়সা জ্বালানি খরচ হয়। আগের অর্থবছর ২০১৯-২০ এ ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিটে ২ টাকা ১৩ পয়সা। এদিকে গত জুলাইয়ে কয়লার ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও কয়লার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব ধরনের জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং গ্যাস সরবরাহ আরও কমে যাওয়ায় চলতি ২০২২ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট জ্বালানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৪ টাকা ২৪ পয়সা। আর জ্বালানি বাবদ মোট ব্যয় বাড়বে ১২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের তুলনায় তা তিন ভাগের এক ভাগের চেয়ে বেশি হবে। তবে সম্প্রতি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা কার্যকর হলে বিদ্যুতের জ¦ালানি খরচ আরও বাড়বে।
পিডিবির প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের ফেব্র‚য়ারিতে বিইআরসি বিদ্যুতের গড় পাইকারি দাম নির্ধারণ করে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা। যদিও গত অর্থবছর গড় পাইকারি বিক্রয় মূল্য পাঁচ টাকা ১২ পয়সায় নেমে যায়। এর ফলে সব মিলিয়ে পিডিবির আয় হয় ৩৯ হাজার ৫২ কোটি টাকা। আর এ বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির ব্যয় হয় ৫০ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। এতে সংস্থাটির লোকসান হয় ১১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ১১ মাসের জন্য (জুলাই ২০২০-মে ২০২১) ভর্তুকি দিয়েছে ১০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ভর্তুকি এখনও অপেক্ষাধীন।
চলতি বছর বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে আট হাজার ৮৯৯ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট। গ্যাসের দাম না বাড়লে এ বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির ব্যয় হবে ৭৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। আর এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হবে ৪৩ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। অর্থাত্ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৫৮ পয়সায় কিনে পাঁচ টাকা আট পয়সায় বিক্রি করবে পিডিবি। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির ফলে চলতি বছর পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে ৩০ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। এ ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুতের পাইকারি দাম আট টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণের আবেদন করেছে পিডিবি। অর্থাত্ বিদ্যুতের পাইকারি দাম প্রতি কিলোওয়াটে সাড়ে তিন টাকা বা ৬৮ দশমিক ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। পাইকারি দাম বৃদ্ধির হারের অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়াতে হবে।
এদিকে পাইকারি দাম বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্যহার নির্ধারণে ডিমান্ড চার্জ আরোপের প্রস্তাবও করেছে পিডিবি। এছাড়া ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের জন্য মূল্যহার ঘাটতি ও দাম বৃদ্ধির পৃথক প্রস্তাবও করেছে সংস্থাটি।
বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ সম্পর্কে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বলেন, পাইকারি দাম বাড়ানো মানে বিতরণ কোম্পানির খরচ বাড়ানো। তাই খরচ বাড়লে গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা দামবৃদ্ধির প্রস্তাবও দেওয়া হবে। তবে সে প্রস্তাব আমরা এখনও তৈরি করিনি।
এ প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। জ¦ালানি ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় পাইকারি দাম এবং পাইকারি দামের উপর ভিত্তি করে খুচরা দাম নির্ধারণ করা হয়। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য ৬টি সংস্থার প্রস্তাব পেয়েছি। বাকি একটির প্রস্তাব পেলে কারিগরি কমিটি তা মূল্যায়ন করবে। তারপর শুনানিসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে গ্যাসের দামেরও প্রভাব থাকবে। পিডিবি যথাযথভাবে প্রস্তাব দেওয়ার পর তা ভেবে দেখা হবে।