বিদ্যুতে ৩৭ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা দিয়ে কী করবে বাংলাদেশ

    Originally posted in the Daily Bnonik Barta on 11 March, 2023

    দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট (সরকারি আরেক হিসাব অনুযায়ী ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট)। ২০২৭ সাল নাগাদ উৎপাদনে (আমদানীকৃতসহ) আসার কথা রয়েছে আরো ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এছাড়া চুক্তি সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সব মিলিয়ে ওই সময়ে দেশে বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ানোর কথা ৪১ হাজার মেগাওয়াটের বেশিতে। তবে সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে অবসরে যাবে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেক্ষেত্রে ২০২৭ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুৎ খাতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৩৭ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশিতে।

    অথচ দেশে এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ খাতের দৈনিক চাহিদা সীমাবদ্ধ থাকছে ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। অব্যবহূত থাকছে ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আগামী চার বছরে এ চাহিদা যদি বার্ষিক ১ হাজার মেগাওয়াট করেও বাড়ে, তবু উদ্বৃত্ত সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়াবে। বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলছে দেশের বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত ক্রমেই সক্ষমতা বাড়িয়ে গেলেও এখনো এর সঙ্গে সংগতি রেখে চাহিদা তৈরি করা যায়নি। আবার বিদ্যুতের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেক্ষেত্রেও সামনের দিনগুলোয় খাতটিতে প্রত্যাশিত মাত্রায় চাহিদা তৈরি করা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে অনেক। সঞ্চালন ব্যবস্থাও দুর্বল। বাড়তি সক্ষমতার ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে গিয়ে এরই মধ্যে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার দশায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এর মধ্যেই আবার ২০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অনুৎপাদনশীল ব্যয় সংস্থাটির দুর্দশাকে আরো চরমে নিয়ে যাওয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে।

    বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে উৎপাদন সক্ষমতায় নতুন করে যুক্ত হবে ১৩ হাজার ১০৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরকারি নতুন ১১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হবে ৪ হাজার ৫৫ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতের (আইপিপি) ১৯ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৫ হাজার ২৫৫ মেগাওয়াট এবং যৌথ বিনিয়োগে নির্মীয়মাণ চার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সক্ষমতা যুক্ত হবে ৩ হাজার ৭৯৩ মেগাওয়াট। এছাড়া চুক্তি সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে বেসরকারি ও যৌথ আরো ২২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ২ হাজার ৫৭৭ মেগাওয়াট।এছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৯৯০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবসরে যাবে বলে বিপিডিবির ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

    দেশে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে ২০১০ সালে প্রথম মহাপরিকল্পনা তৈরি করে সরকার। এটি সংশোধন হয় ২০১৬ সালে। সংশোধিত মহাপরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন সক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মীয়মাণ ও পাইপলাইনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠলে এ লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যেই পূরণ হয়ে যাবে।

    দেশের ক্রমপ্রসারমান অর্থনীতির চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্য থেকে মহাপরিকল্পনায় এ উৎপাদন সক্ষমতার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত সক্ষমতা বেড়ে চললেও সে অনুযায়ী চাহিদা বাড়ানো যায়নি।বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে ৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। যদিও এ সময় প্রতি বছর চাহিদা বেড়েছে গড়ে ৭৬৪ মেগাওয়াট।

    বিদ্যুতের এ চাহিদাহীন সক্ষমতাকেই এখন খাতটির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিষয়টি বিদ্যুৎ খাতের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বিপিডিবির দায়দেনা ও লোকসান বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় এক চাপের কারণ হয়ে উঠবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বড় একটি অংশ নির্মাণ হচ্ছে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নেয়া বিদেশী ঋণের অর্থে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখন দেশের অর্থনীতিকে লাভবান করার পরিবর্তে আরো দায়গ্রস্ত করে তোলার আশঙ্কা তৈরি করছে।

    জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সেই অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি না হলে এটি উদ্বেগের। তবে সবকিছু নির্ভর করছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর। তবে যে হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে তাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমে যেতে পারে। এজন্য সরকারের উচিত হবে নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে এগোনো।’

    পাবনার রূপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ভারতের গড্ডায় আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এরই মধ্যে আমদানি শুরু হয়েছে। পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। সেখানে নির্মাণাধীন রয়েছে একই সক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এছাড়া বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এখন আনুষ্ঠানিক কমিশনিংয়ের অপেক্ষায় রয়েছে।মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিট, রিলায়েন্স ও ইউনিক গ্রুপের গ্যাসভিত্তিক আরো প্রায় ১ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এখন শেষের দিকে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া, চীন, জাপান ও প্রতিবেশী ভারতের মতো দেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রকল্পগুলোর সবক’টিই আগামী চার বছরের মধ্যেই উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠবে।

    ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা এরই মধ্যে বিপিডিবিকে আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে। আগামীতে প্রয়োজনের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত নতুন সক্ষমতা যুক্ত হলে এ ঝুঁকি আরো অনেক বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ বিভাগকে এখনই নতুন প্রকল্পগুলোর বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। বিশেষত এগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার পর সে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খাত তৈরি করা না গেলে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে লোকসান আরো বেড়ে যাবে। আবার এ অতিরিক্ত সক্ষমতা নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগ্রহও কমিয়ে দিতে পারে।’

    বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দিনের বেলায় দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার প্রক্ষেপণ ছিল ১০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। রাতের বেলায় এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এর আগে গত ৯ মার্চ বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা ছিল দিনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৮৪২ মেগাওয়াট ও রাতে সর্বোচ্চ  ২ হাজার ৯৬ মেগাওয়াট।

    সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মহাপরিকল্পনায় বিদ্যুতের চাহিদার যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল, এখন সেটি থেকে খুব বেশি তারতম্য হয়েছে তা বলা যাবে না। বরং শিল্প মালিকদের গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা গেলে চাহিদার পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সঠিক পথেই থাকত। কিন্তু কারিগরি কিছু ত্রুটির কারণে গ্রিডে বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্ন করা যায়নি। শিল্প মালিকরা ক্যাপটিভ বিদ্যুতেই থেকে গেছেন। ফলে চাহিদা ও সক্ষমতায় কিছুটা ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সমন্বিত মহাপরিকল্পনায় এখন চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখেই সামনে এগোনো হচ্ছে।’

    ব্যাপক শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইজেড) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার। পাশাপাশি নেয়া হয় নতুন কিছু শিল্প জোন ও শিল্প নগর নির্মাণের উদ্যোগও। এখন পর্যন্ত এগুলোর বাস্তবায়নের গতি নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে কম।

    সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহায়ক অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলকে সমুদ্র তীরবর্তী শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত একাধিক মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি গড়ে তোলা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর ও একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল। কিন্তু অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবে বৃহৎ এসব প্রকল্পের সুফল নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেছেন বিশেষজ্ঞরা।

    তারা বলছেন, এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রত্যাশিত মাত্রায় শিল্পায়নের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনাগুলো তৈরি করা হয়েছিল। শিল্প খাতের চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় উৎপাদন সক্ষমতা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য নেয়া হয়েছিল। এ অনুযায়ী একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হলেও অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চলগুলোয় পরিকল্পনা অনুযায়ী শিল্পায়ন হয়নি। ফলে বিদ্যুতের প্রচুর পরিমাণ সক্ষমতা অব্যবহূতই থেকে গেছে।