Originally posted in প্রথম আলো on 22 November 2023
প্রথম আলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: আগামীর ভাবনা’ শিরোনামে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। সিপিডি পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি ইউনিট এই আয়োজনে সহযোগিতা করে।
২০০৯ সালে জানুয়ারিতে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এল, তখন বিদ্যুৎ–সংযোগ ছিল সব মিলিয়ে ৪৭ শতাংশ। আর তখন বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা। ২০২১ সালে শতভাগ বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে এটি ২০২২ সালে সম্পূর্ণ হয়। এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৮ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের বড় একটি সফলতা। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ঘর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় একটি অর্জন। এর ফলে আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে; বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। বিদ্যুতের কারণে গ্রামের মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছে, কাজের সন্ধান পেয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় বিদ্যুতে ভর্তুকি দিয়ে আসছেন। সরকার কেন এ খাতে এত ভর্তুকি দেয়, এটি নিয়েও অনেকে প্রশ্ন করেন। এটি সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিনিয়োগ। এটি সহনীয় পর্যায়ে না রাখা গেলে মানুষ তার সঞ্চয় অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারবে না।
আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা, সাশ্রয়ী মূল্যে রাখা, বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়লে তার সঙ্গে সমন্বয় করা। এরপর একদিকে করোনা মহামারি, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি কিছুটা অস্বাভাবিক করে তুলেছে। ওই সময়টা আমাদের কিছুটা লোডশেডিং করতে হয়েছে। যে গ্যাসের দাম ছিল মাত্র ৮ ডলার, তা বেড়ে হয়েছে ৬৪ থেকে ৬৭ ডলার। এখন আবার আমরা ধীরে ধীরে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসছি।
করোনা মহামারির কারণে দুই বছরে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এরপরও বিদ্যুৎ বিভাগ তার অসামান্য অর্জনের কারণে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছে।
যেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, আমাদের অতি দ্রুত সেখানে যাওয়া উচিত। ২০০৯ সালে আমরা যে মিক্স ফুয়েল প্ল্যানিং করেছি, সে জন্যই অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো অবস্থানে আছি। আমরা একক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল নই। আমরা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনছি খুব বেশি নয়, ২ হাজার ১৬০ মেগাওয়াটের মতো। আমরা সম্প্রতি নেপাল থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি আনছি। আমরা কয়লা থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছি না। কয়লা থেকে ১১ থেকে ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। বাকিটা গ্যাস থেকে উৎপাদন করছি। আমাদের তেলভিত্তিক কয়েকটি পাওয়ার প্ল্যান্ট এখনো রয়ে গেছে। বলা যায়, ২৫ থেকে ২৬ শতাংশ বিদ্যুৎ এখান থেকে আসে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ১০ শতাংশে কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন আমরা যে ব্যবস্থা নিচ্ছি, এর কারণে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার অনেক বাড়বে। আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছি।
গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা আওয়ামী লীগ সরকারের বড় একটি সফলতা। আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম রিগ কিনে দিনে অতিরিক্ত ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়িয়েছে। স্থানীয়ভাবে আমাদের ২১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়। আমাদের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ ক্লিন এনার্জি থেকে তৈরি করা হবে। আমাদের গ্যাসভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো কম্বাইন্ড সাইকেল করা হয়েছে, ফলে স্বল্প পরিমাণ গ্যাস দিয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ক্লিন এনার্জির মধ্যেই পড়ে। এতে কার্বন নিঃসরণ নেই বললেই চলে। এ ছাড়া আমরা ছোট ছোট পরিসরে সোলার স্থাপন করছি। আমরা উইন্ড থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করছি। ২০৩০ সালের পর আমরা কয়লার পরিবর্তে হাইড্রোজেন ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করছি। এখানে প্রযুক্তির কিছু বিষয় রয়েছে, যা এখনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। ইন্ডাস্ট্রিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে আমাদের আমদানির কোনো বিকল্প নেই। এটা কিছু পরিমাণ আমাদের আমদানি করতেই হবে, ব্যাপক আকারে নয়।
আমি মনে করি, আমাদের এখন গোছানোর সময় এসেছে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, ২০৩০ সালে একটা স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গায় যাওয়া। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে আসবে। কয়লাভিত্তিক কিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট থাকবে। দু-একটি ব্যতীত ২০৪০ সালের মধ্যে হয়তো এগুলো শেষ হয়ে যাবে। কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে আমরা বড় একটি রূপান্তর ঘটাতে পারব। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বর্তমানে ১০ শতাংশ হলেও সে সময় তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৬ থেকে ২০ শতাংশ। তখন বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে একটা সহনীয় জায়গা তৈরি হবে।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন সঞ্চালন লাইন থাকতে হবে। আমাদের পর্যাপ্ত বিতরণ লাইন থাকতে হবে। আমরা নতুন করে তিন লাখ ৮৩ হাজার কিলোমিটার বিকরণ লাইন করেছি। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে সাবস্টেশন, গ্রিডলাইন স্থাপিত হয়েছে। এরপরও আরও সাবস্টেশন, গ্রিডলাইন প্রয়োজন। শহরের যেসব জায়গায় লোড বেশি, সেসব জায়গা আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যেতে হবে। প্রথমে ঢাকা ও বড় শহরগুলো। সঞ্চালন লাইনকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া একটি বড় কাজ। এগুলো সবই স্মার্ট বাংলাদেশের একটা অংশ। আমরা আশাবাদী, ২০৩৫ সালের মধ্যে পুরো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করব, অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসব। ভবিষ্যতে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হলে এ ব্যবস্থায় আমাদের যেতেই হবে।