Originally posted in The Daily Star on 26 February 2022
চারিদিকে আমরা এখন শুনতে পাই গ্রিন এনার্জি, গ্রিন এনার্জি। এটা আসলে কী? ‘গ্রিন এনার্জি এমন একটি এনার্জি যা সাধারনত তৈরি হয় প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে, যেমন- সূর্যালোক, বায়ুপ্রবাহ বা পানি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং যে উৎপাদ পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না।’ শর্তসাপেক্ষে হাইড্রোজেন গ্যাস একটি গ্রিন এনার্জি, যাকে দাহ্য করা হলে শুধুমাত্র পানি উৎপন্ন করে। তাই এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
এ জন্য আগামী দিনে বিভিন্ন যানবাহন, কল-কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতি খাতে ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে হাইড্রোজেনের ব্যবহার জোরালো হয়ে উঠছে ধরণীকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
তা ছাড়া হাইড্রোজেন গ্যাস বর্তমানে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক গ্যাস অপেক্ষা প্রায় ২ দশমিক ৪ গুন উচ্চমাত্রার শক্তি ধারন করে। এ জন্য পরিবেশ সচেতন রাজনীতিকরা এখন হাইড্রোজেন এনার্জিকে হাইড্রোজেন ইকোনোমি বলতে শুরু করেছেন।
অবশ্য হাইড্রোজেন ইকোনোমির ধারনা কিন্তু সাম্প্রতিককাল থেকে নয়, ৫ দশক আগের। ১৯৭০ সালে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন বকরিস (পরবর্তিতে ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয় অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক) সর্বপ্রথম এই হাইড্রোজেন ইকোনোমির কথা ‘সায়েন্স ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশ করেছিলেন। তারপর থেকেই স্বল্প পরিসরে এই বিষয়ে গবেষনা হয়েছে বটে, কিন্তু এখনকার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।
২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব রিসোর্সেস, এনার্জি অ্যান্ড ট্যুরিজম হাইড্রোজেন এনার্জির বিষয়ে একটা রোডম্যাপ প্রকাশ করে। কিন্তু তাতে এই হাইড্রোজেন এনার্জি ফুয়েল সেল এনার্জিতে ব্যবহারের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে যখন ১৯৪ দেশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ব্যাপক হারে কমানোর ব্যাপারে একমত হয়, তখন থেকেই মূলত এই হাইড্রোজেন এনার্জি বা ইকোনোমির বিষয়টি লাইম লাইট আসে।
যা হোক, আমরা এখন জানার চেষ্টা করি হাইড্রোজেন এনার্জির ক্ষেত্রে বিশ্ব এখন কোন অবস্থায় আছে।
সাধারনত হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা হয় হাইড্রোকার্বন থেকে। তবে হাইড্রোকার্বন নিজেই একটা ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি। শুধুমাত্র গ্রিন বা ক্লিন এনার্জির জন্য হাইড্রোকার্বনকে হাইড্রোজেনে রূপান্তরিত করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যায়। যেখানে সরাসরি হাইড্রোকার্বনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলেই হয়, সেখানে শুধুমাত্র পরিবেশের কথা বিবেচনা করে হাইড্রোকার্বনকে হাইড্রোজেনে পরিবর্তন ঘটিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হলে সেটা না-তো মানুষের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ তৈরি করবে, না বানিজ্যিকভাবেও খুব একটা আকর্ষনীয় হবে।
এ ছাড়া হাইড্রোকার্বনের ব্যবহার কোনো উপায়েই কার্বনমুক্ত কোনো উৎপাদ নিশ্চিত করতে পারে না। যেমন, হাইড্রোকার্বন থেকে সাধারনত Steam Methane Reforming (SMR) পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা হয়, যাতে উপজাত হিসেবে কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। কয়লা বা বায়োমাস থেকে গ্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে হাইড্রোজেন তৈরি করা হয়, উপজাত হিসেবে এখানে প্রচুর পরিমানে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়।
আবার পানি থেকেও যে হাইড্রোজেন তৈরি করা যায় তা অনেক আগে থেকে জানা। পানি থেকে ইলেক্ট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ায় খুব সহজেই হাইড্রোজেন তৈরি করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় ১ কিলোগ্রাম হাইড্রোজেন তৈরি করতে সাধারনত ১০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। আশার কথা হলো, এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো দ্রব্য উৎপন্ন হয় না। ইলেক্ট্রোলাইসিস প্রক্রিয়া যে পাত্রে ঘটানো হয় তাকে ইলেক্ট্রোলাইজার বলে। এতে একটা পজিটিভ ইলেক্ট্রোড (অ্যানোড) ও একটা নেগেটিভ ইলেক্ট্রোড (ক্যাথোড) একটি ইলেক্ট্রোলাইট বা মেমব্রেন দ্বারা বিভক্ত থাকে। যখন বাইরে থেকে সিস্টেমটিতে ইলেক্ট্রিক কারেন্ট প্রয়োগ করা হয়, তখন ক্যাথোডে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং অ্যানোডে উৎপন্ন হয় অক্সিজেন।
কিন্তু মুশকিল হলো, এই প্রক্রিয়ার জন্য বিশুদ্ধ পানি প্রয়োজন। এই বিশুদ্ধ পানি কিন্তু খাওয়ার পানি না। খাওয়ার পানিতে অনেক মিনারেল থাকে। বানিজ্যিকভাবে ইলেক্ট্রোলাইসিসের জন্য দরকার পরিশুদ্ধ পানি, যেটার উৎপাদন এখনও ব্যয়বহুল। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এখন এই বিষয়ে গবেষনা করছেন, কী উপায়ে পানিকে পরিশুদ্ধ করলে বানিজ্যিকভাবে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে অবিশুদ্ধ পানি, যেমন- সমুদ্রের পানি থেকে সরাসরি কীভাবে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা যায়, সে বিষয়েও বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এই দিক থেকে অস্ট্রেলিয়া একধাপ এগিয়ে আছে। আগামী দিনের জ্বালানির ভবিষ্যৎ হিসেবে অষ্ট্রেলিয়া সরকার এই হাইড্রোজেন এনার্জির কথাই বিবেচনা করছে। এই লক্ষ্যে হাইড্রোজেন এনার্জি নিয়ে গবেষনার জন্য অস্ট্রেলিয়ার সরকার বিভিন্ন গবেষনা প্রতিষ্ঠানে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করছে।
অস্ট্রেলিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, হাইড্রোজেন এনার্জি গবেষনা ওহাইড্রোজেন ইন্ডাষ্ট্রি গঠনের জন্য সরকার এখন পর্যন্ত ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। অস্ট্রেলিয়া সরকার এটাকে একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ এবং বড় ধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছে। কারন, অস্ট্রেলিয়া একটি সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপরাষ্ট্র। এর পশ্চিমে ভারত মহাসাগর, পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর। তাই হাইড্রোজেন তৈরির কাঁচামাল, পানির উৎস নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
এখানকার বিজ্ঞানীরা তাই সমুদ্রের পানি থেকেই বানিজ্যিকভাবে হাইড্রোজেন উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কারের দিকে মনোযোগী হয়েছেন। সরকারি ভাষ্যমতে, বানিজ্যিকভাবে বলতে ২ ডলারের নিচে প্রতি কিলোগ্রাম হাইড্রোজেন উৎপাদনকে বোঝানো হয়েছে। এই লক্ষ্য সফল হলে অস্ট্রেলিয়া সরকার বিভিন্ন দেশে হাইড্রোজেন রপ্তানি করার মহাপরিকল্পনাও করছে।
সমুদ্রের পানি থেকে হাইড্রোজেন উৎপাদন মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কারন সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমানে ক্লোরাইড আয়ন রয়েছে, যা ইলেক্ট্রোলাইসিসের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। সমুদ্রের ক্লোরাইডযুক্ত লবনাক্ত পানি ইলেক্ট্রোলাইসিসের জন্য ব্যবহৃত ইলেক্ট্রোডকেই আক্রমন করে তার কার্যদক্ষতা কমিয়ে দেয়। এই বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছুটা সফলতা দেখিয়েছেও অবশ্য।
বিশ্ববিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. দাঈ এর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল এমন একটি অ্যানোড (ইলেক্ট্রোড) তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যা ক্লোরাইডের আক্রমন থেকে ইলেক্ট্রোডটিকে বাঁচাতে সহায়তা করে। তিনি প্রথমে একটি তড়িৎ পরিবাহী নিকেল ধাতুর ফোমের কোর তৈরি করে তাতে নিকেল সালফাইডের প্রলেপ দেন। এর ওপর নিকেলজাত একটি প্রভাবক ব্যবহার করেন। ইলেক্ট্রোলাইসিসের সময় এই নিকেল সালফাইড প্রলেপ প্রভাবকের উপস্থিতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে নেগেটিভ সালফাইড আয়ন তৈরি করে যা আগত ক্লোরাইডকে নিকেল ধাতুর কোরের কাছে আসতে বাঁধা দেয়। ফলে অ্যানোডটি থাকে সুরক্ষিত। তবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষনা ইন্সটিটিউট এই জাতীয় বিষয়ের সমাধান করার জন্য গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে।
শেষ করার আগে ভবিষ্যৎ গবেষকদের কিছু তথ্য দিয়ে শেষ করতে চাই।
হাইড্রোজেন এনার্জি আগামীতে একটি অত্যন্ত চাহিদা সম্পন্ন বিষয়ে পরিনত হতে যাচ্ছে। ইউরোপ, কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ এমন কোনো দেশ নেই যারা এই হাইড্রোজেন এনার্জি নিয়ে গবেষনা করছে না। আগামী কয়েক দশক এই বিষয়টি সব সময় লাইম লাইটেই থাকবে। আমি ধারনা করছি, আগামী ১ দশকের মধ্যে হাইড্রোজেন এনার্জি নিয়ে গবেষনার জন্য রসায়ন নোবেল পুরষ্কার পাবে।
আর হাইড্রোজেনের বানিজ্যিক চাহিদাও থাকবে জ্বালানির শীর্ষে। জাপান তো ঘোষনা দিয়ে রেখেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা জীবাশ্ম জ্বালানি অর্ধেকে নামিয়ে আনবে, বাকি অর্ধেক গ্রিন এনার্জি (হাইড্রোজেন এনার্জি এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে) তাদের চাহিদা পুরন করবে।
অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাইড্রোজেন রপ্তানিকারক দেশ হতে যাচ্ছে। কারন তাদের সাপ্লাই চেইন অনেক বড়, পরিপক্ক ও স্থায়ী, যা অধিকাংশ উন্নত দেশেরও নেই। এ ক্ষেত্রে দেশটি তাদের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানি করার অবকাঠামো ব্যবহার করে খুব সহজেই হাইড্রোজেনকে তরলীকরন করে বিশেষায়িত কার্গো জাহাজে বিদশে পাঠাতে পারবে।
জাপান ও দক্ষিন কোরিয়া ইতোমধ্যে তাদের চাহিদাপত্র অস্ট্রেলিয়াকে দিয়ে রেখেছে। অস্ট্রেলিয়া আশা করছে ২০৩০ সালের মধ্যে হাইড্রোজেন এনার্জি খাতে ২ হাজার ৮০০ নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে এবং এর বাজার থাকবে বার্ষিক প্রায় ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
ড. শুভংকর বিশ্বাস, চার্টার্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় একটি সোনার খনিতে সিনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত