Originally published in Bonik Barta on 17 July 2023
দেশে গ্যাসভিত্তিক তিনটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলতি বছর চালু হওয়ার কথা রয়েছে। প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে সামিট পাওয়ার, ইউনিক ও রিলায়েন্স গ্রুপ। নতুন এ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৯ সালে ক্রয় চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। আর এসব চুক্তিতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম হিসাব করা হয় ডলারে। ওই সময়ে প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরে চুক্তি হয়েছিল। যদিও তখন মার্কিন এ মুদ্রার বাজার দর ছিল ৮৫ টাকার মতো। দুই বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় মূল্য ২৮ শতাংশ বেড়ে এখন ১০৯ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। চালুর পর তাই এ তিন কেন্দ্রের বিদ্যুৎ মূল্য কিংবা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ডলারের চলতি বিনিময় হার ধরে। দেশের বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্র (আইপিপি) থেকে এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদ্যুৎ কেনাকে আত্মঘাতী পথ হিসেবে দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ খাতের স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে বিপিডিবির কাছেই বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হয়। তাই দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আইপিপিগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে স্থানীয় মুদ্রার একটা সুযোগ রাখা যেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু সেটি করা হয়নি। ফলে বিদ্যমান বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি, ক্রয় চুক্তি—এগুলো হয়েছে যেভাবে লবিস্টরা চেয়েছে। কাঠামোগুলো যেভাবে তৈরি করা হয়েছে সেভাবে চুক্তি হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের অর্থকে সুরক্ষা দেয়াই উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন যাতে তাদের অসুবিধা না হয়। আর সে কারণেই দায়মুক্তি আইন করা হয়েছে। এ আইনে জনসাধারণের আর্থিক ক্ষতি ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয় এ খাতে কোনোভাবেই রক্ষিত হয়নি।’
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের (ইউএমপিএল) সঙ্গে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করে বিপিডিবি। ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে চুক্তি হয় ডলারে। স্থানীয় গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চললে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছিল ২ টাকা ৯৫ পয়সা। আর রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে চললে প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে ৫ টাকা ৪৪ পয়সা। ২২ বছর মেয়াদি এ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির প্রতি বছরের জন্য ইউনিটপ্রতি ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণ করা হয়।
বিপিডিবির সঙ্গে ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্সের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয় ৫ টাকা ৮৪ পয়সা।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে গত দেড় দশকে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ বাদে)। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় হাজার মেগাওয়াট। বেসরকারি এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে বিপিডিবি সিংহভাগ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করেছে ডলারে। যদিও অধিকাংশ কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় টাকায়। তাও ডলারের চলতি বিনিময় হার ধরে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকটের কারণেও বকেয়া পড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিল। বিশেষত বিপিডিবির কাছে স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর বিপুল অংকের বিল এখনো বকেয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলারে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির বিষয়টি এরই মধ্যে সরকারের নজরে এসেছে। তবে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এর সুযোগ কম। নতুন করে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে নির্মাণ চুক্তি হবে সেখানে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করবে সরকার।’
ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহতভাবেই বেড়ে চলেছে। ২০২১ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৮৫ থেকে ১০৯ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ পরিস্থিতিতে বিপিডিবির লোকসানও বাড়ছে দিন দিন। বিপিডিবির আর্থিক হিসাবে দেখা গেছে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটির আর্থিক লোকসান হয়েছে ৬১২ কোটি টাকা। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে এ লোকসান দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে বিপিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আবার ২০২৭ সাল নাগাদ বেসরকারি খাতে আরো অন্তত ৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট (চলতি বছরসহ) বিদ্যুৎ সক্ষমতা যুক্ত হবে। সংশ্লিষ্ট সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বৃদ্ধি পেতে থাকলে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সক্ষমতা বাড়াতে একটা বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থায়নে এ খাতে বিনিয়োগ এসেছিল। ফলে সেই সময়কার প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী, আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে ডলারেই চুক্তিগুলো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্থানীয় বিদ্যুৎ খাতে উদ্যোক্তারা তাদের আর্থিক ঝুঁকি কমাতে ডলারে চুক্তির বিষয়টির ধারা অব্যাহত রেখেছে। যদিও স্থানীয় মুদ্রায় বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ ছিল। সেটি করা গেলে ডলার নিয়ে আর্থিক লোকসানের ঝুঁকিটা এত বেশি তৈরি হতো না।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে ঠিক আগের প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তুলনায় অবমূল্যায়ন হয়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ শেষে ডলারের মূল্যমান ছিল ১০৬ দশমিক ৮০ টাকা। গতকাল ১৬ জুলাই তা বেড়ে ১০৯ টাকা হয়।
ডলারের বাজারদর আরো ঊর্ধ্বমুখী হলে সামনে বিপিডিবিকে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি কোম্পানিগুলো যেহেতু লোকাল প্রডিউসার। ফলে তাদের সঙ্গে স্থানীয় বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির এক ধরনের সুযোগ ছিল। কিন্তু এসব চুক্তি ছিল এক প্রকার গোপনীয়। এখানে জনসাধারণের এসব চুক্তির বিষয়ে জানার সুযোগ ছিল না। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আর্থিক ঘাটতি যেমন বাড়ছে, তেমনি এসব কোম্পানির বিল পরিশোধেও পর্যাপ্ত ডলারের মজুদ নেই। রিজার্ভ থেকে দেয়ার এখন তেমন সুযোগও নেই। আগামীতে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন অব্যাহত থাকলে তা এ খাতের জন্য ভয়াবহ হবে।’